নাক ডাকার বিপদ-আপদ
ডাঃ কুন্তল মাইতি
2019-01-24 14:08:16

নাক ডাকার বিপদ-আপদ
বয়স বাড়লে বেশির ভাগ মানুষের নাক ডাকার প্রবণতা বেড়ে যায়। এর কারণ নাক থেকে ফুসফুস অবধি বাতাস চলাচলের পথে থাকা টিসু গুলো একটু ঢিলে হয়ে যায় এবং কম্পিত হতে থাকে। হঠাৎ করে যদি ওজন বেড়ে যায় অর্থাৎ মাস দুয়েকের মধ্যে যদি পাঁচ-ছ’ কেজি ওজন বেড়ে যায় তখন ওই টিসু গুলোতে চর্বি জমা হয়ে কিংবা পেটের ভুড়িতে যে ফ্যাট জমা হয় তার কারণে চাপ পড়ে এবং বাতাস চলাচলের জায়গাটা সরু হয়ে কম্পন হয় ও নাক ডাকা শুরু হয়।
প্যারামিটারকে অসুবিধায় না ফেলে অর্থাৎদিনেরবেলায় ঝিমোচ্ছেন কিনা, প্রেসার-সুগারের অসুবিধা আছেন কিনা, হঠাৎকরে ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিনা, নাক ডাকার কারণে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, এতটাই নাকডাকছে যে নিজের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসছেন, আবার তারপর শুয়ে পড়ছেন—এইসব লক্ষণ দেখে।
নাক ডাকা মানেই কি অসুখ
নাক ডাকা মানেই যে সবসময় অসুখ বলে ধরে নেওয়া হবে তা কিন্তু নয়।
জীবন শৈলীর পরিবর্তন, ব্যায়াম, স্বাস্থ্যসম্মতখাওয়া, কিছু ওষুধপত্রের ব্যবহারেও যখন ব্যাপারটাকে কমানো যায়না, তখন অস্ত্রোপাচারের প্রয়োজন পড়ে।এছাড়া পলিসোমনোগ্রাফি পরীক্ষার সাহায্যেও বোঝা যায় সমস্যার গভীরতা।রোগীর নাক-কান-গলার, ফ্যারিংস অঞ্চলে কিছু কিছু অংশে সমস্যা থাকে।যার কারণে ঘুমের মধ্যে সঠিক ভাবে শরীরে অক্সিজেন যায় না।এই অক্সিজেন ঠিক মতো না যাওয়ার কারণে গাঢ় ঘুমটা তার কখনোই হয়না।ফলে ঘুমের যে উপকারিতা তা তিনি পাননা।এর জন্য দায়ী শ্বাস নেওয়ার জায়গাটায় কিছু অবরোধ। এই অবরোধ জনিত রোগী অর্থাৎ অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়ার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
হঠাৎহঠাৎঘুম পেয়ে যায় কারো কারো সেন্ট্রাল স্লিপঅ্যাপনিয়ার কারণে মাথায় বিভিন্ন রকম ফেনোমেনা ঘটে ব্রেনের মধ্যে।ফলে ব্রেন হঠাৎকরে ঝিমিয়ে পড়ে।ব্রেনের অ্যালার্ঠনেস কমে যায়।নিউরোট্রান্স মিটার লেভেল ডাউন হয়ে যায়।এরপর যদি হঠাৎকরে কোনো হরমোনাল সিগন্যাল যায় যে শরীর ঘুম চাইছে তাহলে ঘুম পায়।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়া হয় বিভিন্ন কারণে। যেমন নাকের হাড় বাঁকা হতে পারে। নাকের মধ্যে যে মাংস গুলো থাকে ডাক্তারি পরিভাষায় যা কে টারবিনেটটস বলে যা সাধারণ মানুষ পলিপ বলেই জানে, সেই মাংস গুলো বা পলিপ যদি বেড়ে যায়।অ্যালার্জি বেশি থাকলে বা অন্যান্য কারণে পলিপ হতে পারে। ফলে নাকের মধ্যে বাতাস চলাচলের রাস্তা সরু হয়ে যায় এবং যখন সেই রাস্তা নির্দিষ্ট সীমার (ক্রিটিক্যালপয়েন্ট) বাইরে চলে যায় তখন সাধারণ ভাবে নাকের ভিতর দিয়ে শ্বাস যেতেই পারেনা। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে দেখা দেয় ঘুমের মধ্যে ‘হাঁ’ করে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া। ‘হাঁ’ করে শ্বাস নেওয়ার ফলে নাকটার ব্যবহার কম হয়, জায়গায়টা আরও চেপে যায়। ‘হাঁ’ করে শ্বাস নেওয়ার কারণে টনসিল অ্যাডিনয়েড আরো বেড়ে গিয়ে মুখ দিয়েও শ্বাস নেওয়ার অসুবিধা হয়। জিভের পিছনটা বেড়ে যেতে থাকে।ফলে ঘুমের সময় শ্বাস বাধা প্রাপ্ত হওয়ার শরীরে মেটাবলিজম ক্রিয়া কলাপ গুলো থিতিয়ে আসার কথা, রিস্টোর করে শরীরটা কে নতুন করে জাগিয়ে তোলার কথা—সেই জায়গাটার খামতি রয়ে যায়। ফলে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরও শরীর আবার ঘুমের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে—এরা সব সময় বলে, ঘুমটা ভালো হলনা।ফলে কাজে এদের কোনো উৎসাহ থাকেনা, কাজের মধ্যে ঝিমোতে থাকে।সব সময় শুয়ে-বসে থাকতে ইচ্ছে করে।যার সুগার-প্রেসার ছিলনা তার সুগার-প্রেসার বেড়ে যেতে পারে, ওষুধে নিয়ন্ত্রণ হতে চায়না।বন্থু-বান্ধবের সঙ্গে মিশতে ইচ্ছে করেনা, পার্টিতে যেতে ইচ্ছে করেনা, বিবাহিত জীবনে শারীরিক ভাবে মিলিত হতে ইচ্ছে করেনা।এই ধরনের ব্যাপার গুলো ঘটে প্রাথমিক স্তরে কিংবা বেড়ে গেলেও এইসব লক্ষণ দেখা যায়।তবে এদের ওজন কমেনা, অক্সিজেন পুরোপুরি জায়না বলে ক্যালোরি খরচ করার ক্ষমতা কম থাকে, ফলে অল্প খেলেও রোগী মোটা হয়ে যায়।এই সব মানুষদের ওবেসিটি বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছয় যার ফলে যেকোনো সময়ে একটা ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে।ঘুমের মধ্যে কার্ডিয়াক সমস্যা হওয়াটাও বিচিত্র নয়।অনেক ক্ষেত্রে এই সমস্যার কারণে ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হতেও দেখা গেছে।
রোগীর কাজে কর্মে উৎসাহ হারানো, সুগার-প্রেসার বাড়া, থাইরয়েডের সমস্যা বেড়ে যাওয়া, কোনো ওষুধ কাজ না করা, ওজন বেড়ে যাওয়া, কাজকর্মে ভুল, হিসাবপত্রে ভুল, সূক্ষ্ম জিনিস মনে রাখতে পারার সমস্যা, স্মৃতিশক্তি লোপ,ফ্যামিলি লাইফ হ্যাম্পার হওয়া, তার সঙ্গে অ্যারিথমিয়া, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এবং ব্রেনস্ট্রোক হওয়াও বিচিত্র নয়।
সেন্টাল স্লিপঅ্যাপনিয়ায় ওবেসিটি বেশি থাকেনা।নাক-মুখ-গলায়গঠনগত ভাবে অস্বাভাবিকতা কম থাকে।তবুও দেখা যায় রোগীর ঘুম ঘুম ভাব এবং হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
রান্না করতে করতে চোখ লেগে যাওয়ার কারণে গ্যাস থেকে দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়।গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ ঘুমের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।ভালো সাঁতার জানা সত্ত্বেও নদী বা পুকুরে তলিয়ে যেতে পারে এই হঠাৎ ঘুমের কারণে। ছাদে উঠে কাজ কর্ম করতে করতে ঘুমের কারণে ছাদ থেকে পড়ে যেতে পারে। শ্রমিকদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা হলে উঁচু থেকে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঘুম এসে কাজের একাগ্রতা কমিয়ে দেয় বলে এইধরনের দুর্ঘটনা ঘটে।
এইধরনের দুর্ঘটনার কবলে যারা পড়েন তাদের স্টাডি করে ডাক্তার বাবুরা বুঝতে পারেন। অবস্ট্রাকটিভস্লিপঅ্যাপনিয়া যা ব্রেনের কারণে হয় বা একধরনের এপিলেপ্সি অথবা নার্কোলেক্সি দায়ী থাকে।
লক্ষণ বলতে রোগীর যখন ঘুমোনোর কথা নয় তখন ঘুমোনো, কাজে মন বা ইচ্চা না থাকা, মনে না রাখাতে পারা, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা, একা একা থাকতে ইচ্ছে করা ইত্যাদি। এর সাথে সুগার বেড়ে যাওয়া, প্রেসার বাড়া, ওজনবাড়া ইত্যাদি যা ওষুধ খেয়েও নিয়ন্ত্রণ হয়না।
আবার যাদের এসব সমস্যা নেই অর্থাৎ ওজন বেশি নয়, খুব নাক ডাকেন না, সুগার-প্রেসার স্বাভাবিক, থাইরয়েডের কোনো সমস্যা নেই, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনশৈলী, সময় মতো ঘুমোতে যান, তা সত্ত্বেও হঠাৎ হঠাৎ ঘুম এসে যায়, সেক্ষেত্রে ব্রেনের কিছু সমস্যার কথা ভাবতে হবে।
চিকিৎসা
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়ার চিকিৎসা করতে হবে। ই.এন.টি চিকিৎসকদের কাছে এখন অনেক রকম চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, অনেক রকম যন্ত্রপাতি আছে। ফলে যে জায়গায় অবরোধ হচ্ছে সেটা খুলে দেওয়া সম্ভব।এর সাথে রোগীর কিছু কাউন্সেলিং, জীবনশৈলীর পরিবর্তন অর্থাৎ ঠিকঠাক সময়ে খাওয়া, ঘুমোনো, জাঙ্কফুড না খাওয়া, ব্যায়াম করা এগুলোর ওপর নজর দিতে হয়।
প্রত্যেক মানুষেরই পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন।শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোর একটা সময় বিশ্রামের দরকার হয়। আমরা বলি ঘুমোলে শরীর বিশ্রাম পাবে। আসলে তা হয়না। ঘুমের সময় শরীর নিজের মেটাবলিজমকে রি-অর্গানাইজড করে পরের দিনের জন্য। সকাল বেলায় মানুষ ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু যে মানুষটা রাত দুটোয় ঘুমোতে যান তার তো আর স্বাভাবিক সকাল হয়না। তার সকাল হয় দশটা-এগারোটা নাগাদ। আজকাল আমরা সবাই ব্যস্ত। অনেক সময় পার্টি বা কাজের জন্য ঘুমোতে দেরি হয়, টেনশনের কারণে ঘুম আসেনা।ফলে আমাদের শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়।
দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার কারণে বায়োলজিক্যাল ক্লক ও ঘুম ভাঙার মধ্যে একটা অসামঞ্জস্যতা হয় এবং অনেক রকম মেটাবলিক সমস্যা, হরমোনজনিত সমস্যা দেখা দেয়।ফলে নানা রকম রোগ এসেআমাদের শরীরে বাসা বাঁধে যেগুলোকে আমরা লাইফস্টাইল ডিজিজ বলি। যেমন ওবেসিটি, ডায়াবেটিস-প্রেসারেরসমস্যা, অ্যাংজাইটি, দুশিন্তা, ইনসমনিয়া, স্ট্রেসরিলেটেড, স্ট্রোক ইত্যাদি এই জাতীয় সমস্যাগুলো কিন্তু বাড়ছে। শরীরের সমস্ত মেটাবলিক সিস্টেম এবং হরমোনাল সিস্টেম গুলো ঠিকঠাক থাকছেনা।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক মানুষকে বেশি বেশি ঘুমোতে দেখা যায়। যে সময় সাধারণত তার ঘুমোনোর কথা নয়, সেসময়ও ঘুমোচ্ছেন। এর কিছু কিছু কারণ থাকে যার মধ্যে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়া হল অন্যতম।
পলিসোমনো গ্রাফি করার সুবিধা সব জায়গায় পাওয়া যায়না। এমনকী অনেক সময়সরকারি হাসপাতাল গুলোতেও সেসব সুবধা মেলেনা। এই পরীক্ষা খুব খরচ সাপেক্ষ। প্রায়ছ’-সাত হাজার টাকা খরচ হয়। তাই ডাক্তারবাবুরা সবাইয়ের এই পরীক্ষা করান না। ই.এন.টি বিশেষজ্ঞরা রোগী কেস হিস্ট্রি শুনে বুঝতে পারেন কার করানো উচিত। রোগীকে দেখে এবং ক্লিনিক্যালি পরীক্ষাকরে বা বাড়ির লোক বা রোগীর কাছ থেকে সমস্যা ও ইতিহাস শুনে বুঝতে পারেন সমস্যাটা ঠিক কতটা গভীর।
ঘুমের মধ্যে অক্সিজেন স্যাচুরেটেড লেভেল ক্রিটিক্যাল লেভেলের নীচে নেমে যায় কিনা, ই.সি.জি করে দেখতে হয় হার্টরেট খুব ওঠা-নামা করে কিনা। কারণ এর ফলে পরে কার্ডিয়াক সমস্যা হতে পারে। এইসব সমস্যা যদি না থাকে তা হলে অপারেশন করার প্রয়োজন নেই।
অনেক সময় অপারেশনে একটা স্টেজে সাফল্য আসেনা। তখন দুটো স্টেজে করতে হয়। সিভিয়ার কেসে তিনটে স্টেজও লাগতে পারে। তবে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম স্টেজেই সাফল্য মেলে।
তবে এই রোগটা এমন নয় যে চিকিৎসকের কাছে গেলাম, কিছু ওষুধ খেলাম, পুরোফিট হয়ে গেলাম—ব্যাপারটা মোটেই কিন্তু তা নয়। এইসমস্যাটা অনেক দিন ধরে চলার ফলে শরীরে সমস্ত সিস্টেম উল্টো পাল্টা হয়ে যায়। সেই সিস্টেমটা কে ঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রোগীকে সাধারণ জীবন যাত্রায় ফিরিয়ে আনা একটু সময় সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে রোগী ও তার বাড়ির লোকের সহায়তা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রেন রিলেটেড কারণে যে বেশি বেশি ঘুম হয় সেখানে অপারেশনের কোনো ভূমিকা নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আধুনিক কিছু ওষুধ পত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বয়স বাড়লে বেশির ভাগ মানুষের নাক ডাকার প্রবণতা বেড়ে যায়। এর কারণ নাক থেকে ফুসফুস অবধি বাতাস চলাচলের পথে থাকা টিসু গুলো একটু ঢিলে হয়ে যায় এবং কম্পিত হতে থাকে। হঠাৎ করে যদি ওজন বেড়ে যায় অর্থাৎ মাস দুয়েকের মধ্যে যদি পাঁচ-ছ’ কেজি ওজন বেড়ে যায় তখন ওই টিসু গুলোতে চর্বি জমা হয়ে কিংবা পেটের ভুড়িতে যে ফ্যাট জমা হয় তার কারণে চাপ পড়ে এবং বাতাস চলাচলের জায়গাটা সরু হয়ে কম্পন হয় ও নাক ডাকা শুরু হয়।
প্যারামিটারকে অসুবিধায় না ফেলে অর্থাৎদিনেরবেলায় ঝিমোচ্ছেন কিনা, প্রেসার-সুগারের অসুবিধা আছেন কিনা, হঠাৎকরে ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিনা, নাক ডাকার কারণে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, এতটাই নাকডাকছে যে নিজের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসছেন, আবার তারপর শুয়ে পড়ছেন—এইসব লক্ষণ দেখে।
নাক ডাকা মানেই কি অসুখ
নাক ডাকা মানেই যে সবসময় অসুখ বলে ধরে নেওয়া হবে তা কিন্তু নয়।
জীবন শৈলীর পরিবর্তন, ব্যায়াম, স্বাস্থ্যসম্মতখাওয়া, কিছু ওষুধপত্রের ব্যবহারেও যখন ব্যাপারটাকে কমানো যায়না, তখন অস্ত্রোপাচারের প্রয়োজন পড়ে।এছাড়া পলিসোমনোগ্রাফি পরীক্ষার সাহায্যেও বোঝা যায় সমস্যার গভীরতা।রোগীর নাক-কান-গলার, ফ্যারিংস অঞ্চলে কিছু কিছু অংশে সমস্যা থাকে।যার কারণে ঘুমের মধ্যে সঠিক ভাবে শরীরে অক্সিজেন যায় না।এই অক্সিজেন ঠিক মতো না যাওয়ার কারণে গাঢ় ঘুমটা তার কখনোই হয়না।ফলে ঘুমের যে উপকারিতা তা তিনি পাননা।এর জন্য দায়ী শ্বাস নেওয়ার জায়গাটায় কিছু অবরোধ। এই অবরোধ জনিত রোগী অর্থাৎ অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়ার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
হঠাৎহঠাৎঘুম পেয়ে যায় কারো কারো সেন্ট্রাল স্লিপঅ্যাপনিয়ার কারণে মাথায় বিভিন্ন রকম ফেনোমেনা ঘটে ব্রেনের মধ্যে।ফলে ব্রেন হঠাৎকরে ঝিমিয়ে পড়ে।ব্রেনের অ্যালার্ঠনেস কমে যায়।নিউরোট্রান্স মিটার লেভেল ডাউন হয়ে যায়।এরপর যদি হঠাৎকরে কোনো হরমোনাল সিগন্যাল যায় যে শরীর ঘুম চাইছে তাহলে ঘুম পায়।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়া হয় বিভিন্ন কারণে। যেমন নাকের হাড় বাঁকা হতে পারে। নাকের মধ্যে যে মাংস গুলো থাকে ডাক্তারি পরিভাষায় যা কে টারবিনেটটস বলে যা সাধারণ মানুষ পলিপ বলেই জানে, সেই মাংস গুলো বা পলিপ যদি বেড়ে যায়।অ্যালার্জি বেশি থাকলে বা অন্যান্য কারণে পলিপ হতে পারে। ফলে নাকের মধ্যে বাতাস চলাচলের রাস্তা সরু হয়ে যায় এবং যখন সেই রাস্তা নির্দিষ্ট সীমার (ক্রিটিক্যালপয়েন্ট) বাইরে চলে যায় তখন সাধারণ ভাবে নাকের ভিতর দিয়ে শ্বাস যেতেই পারেনা। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে দেখা দেয় ঘুমের মধ্যে ‘হাঁ’ করে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া। ‘হাঁ’ করে শ্বাস নেওয়ার ফলে নাকটার ব্যবহার কম হয়, জায়গায়টা আরও চেপে যায়। ‘হাঁ’ করে শ্বাস নেওয়ার কারণে টনসিল অ্যাডিনয়েড আরো বেড়ে গিয়ে মুখ দিয়েও শ্বাস নেওয়ার অসুবিধা হয়। জিভের পিছনটা বেড়ে যেতে থাকে।ফলে ঘুমের সময় শ্বাস বাধা প্রাপ্ত হওয়ার শরীরে মেটাবলিজম ক্রিয়া কলাপ গুলো থিতিয়ে আসার কথা, রিস্টোর করে শরীরটা কে নতুন করে জাগিয়ে তোলার কথা—সেই জায়গাটার খামতি রয়ে যায়। ফলে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরও শরীর আবার ঘুমের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে—এরা সব সময় বলে, ঘুমটা ভালো হলনা।ফলে কাজে এদের কোনো উৎসাহ থাকেনা, কাজের মধ্যে ঝিমোতে থাকে।সব সময় শুয়ে-বসে থাকতে ইচ্ছে করে।যার সুগার-প্রেসার ছিলনা তার সুগার-প্রেসার বেড়ে যেতে পারে, ওষুধে নিয়ন্ত্রণ হতে চায়না।বন্থু-বান্ধবের সঙ্গে মিশতে ইচ্ছে করেনা, পার্টিতে যেতে ইচ্ছে করেনা, বিবাহিত জীবনে শারীরিক ভাবে মিলিত হতে ইচ্ছে করেনা।এই ধরনের ব্যাপার গুলো ঘটে প্রাথমিক স্তরে কিংবা বেড়ে গেলেও এইসব লক্ষণ দেখা যায়।তবে এদের ওজন কমেনা, অক্সিজেন পুরোপুরি জায়না বলে ক্যালোরি খরচ করার ক্ষমতা কম থাকে, ফলে অল্প খেলেও রোগী মোটা হয়ে যায়।এই সব মানুষদের ওবেসিটি বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছয় যার ফলে যেকোনো সময়ে একটা ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে।ঘুমের মধ্যে কার্ডিয়াক সমস্যা হওয়াটাও বিচিত্র নয়।অনেক ক্ষেত্রে এই সমস্যার কারণে ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হতেও দেখা গেছে।
রোগীর কাজে কর্মে উৎসাহ হারানো, সুগার-প্রেসার বাড়া, থাইরয়েডের সমস্যা বেড়ে যাওয়া, কোনো ওষুধ কাজ না করা, ওজন বেড়ে যাওয়া, কাজকর্মে ভুল, হিসাবপত্রে ভুল, সূক্ষ্ম জিনিস মনে রাখতে পারার সমস্যা, স্মৃতিশক্তি লোপ,ফ্যামিলি লাইফ হ্যাম্পার হওয়া, তার সঙ্গে অ্যারিথমিয়া, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এবং ব্রেনস্ট্রোক হওয়াও বিচিত্র নয়।
সেন্টাল স্লিপঅ্যাপনিয়ায় ওবেসিটি বেশি থাকেনা।নাক-মুখ-গলায়গঠনগত ভাবে অস্বাভাবিকতা কম থাকে।তবুও দেখা যায় রোগীর ঘুম ঘুম ভাব এবং হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
রান্না করতে করতে চোখ লেগে যাওয়ার কারণে গ্যাস থেকে দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়।গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ ঘুমের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।ভালো সাঁতার জানা সত্ত্বেও নদী বা পুকুরে তলিয়ে যেতে পারে এই হঠাৎ ঘুমের কারণে। ছাদে উঠে কাজ কর্ম করতে করতে ঘুমের কারণে ছাদ থেকে পড়ে যেতে পারে। শ্রমিকদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা হলে উঁচু থেকে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঘুম এসে কাজের একাগ্রতা কমিয়ে দেয় বলে এইধরনের দুর্ঘটনা ঘটে।
এইধরনের দুর্ঘটনার কবলে যারা পড়েন তাদের স্টাডি করে ডাক্তার বাবুরা বুঝতে পারেন। অবস্ট্রাকটিভস্লিপঅ্যাপনিয়া যা ব্রেনের কারণে হয় বা একধরনের এপিলেপ্সি অথবা নার্কোলেক্সি দায়ী থাকে।
লক্ষণ বলতে রোগীর যখন ঘুমোনোর কথা নয় তখন ঘুমোনো, কাজে মন বা ইচ্চা না থাকা, মনে না রাখাতে পারা, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা, একা একা থাকতে ইচ্ছে করা ইত্যাদি। এর সাথে সুগার বেড়ে যাওয়া, প্রেসার বাড়া, ওজনবাড়া ইত্যাদি যা ওষুধ খেয়েও নিয়ন্ত্রণ হয়না।
আবার যাদের এসব সমস্যা নেই অর্থাৎ ওজন বেশি নয়, খুব নাক ডাকেন না, সুগার-প্রেসার স্বাভাবিক, থাইরয়েডের কোনো সমস্যা নেই, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনশৈলী, সময় মতো ঘুমোতে যান, তা সত্ত্বেও হঠাৎ হঠাৎ ঘুম এসে যায়, সেক্ষেত্রে ব্রেনের কিছু সমস্যার কথা ভাবতে হবে।
চিকিৎসা
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়ার চিকিৎসা করতে হবে। ই.এন.টি চিকিৎসকদের কাছে এখন অনেক রকম চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, অনেক রকম যন্ত্রপাতি আছে। ফলে যে জায়গায় অবরোধ হচ্ছে সেটা খুলে দেওয়া সম্ভব।এর সাথে রোগীর কিছু কাউন্সেলিং, জীবনশৈলীর পরিবর্তন অর্থাৎ ঠিকঠাক সময়ে খাওয়া, ঘুমোনো, জাঙ্কফুড না খাওয়া, ব্যায়াম করা এগুলোর ওপর নজর দিতে হয়।
প্রত্যেক মানুষেরই পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন।শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোর একটা সময় বিশ্রামের দরকার হয়। আমরা বলি ঘুমোলে শরীর বিশ্রাম পাবে। আসলে তা হয়না। ঘুমের সময় শরীর নিজের মেটাবলিজমকে রি-অর্গানাইজড করে পরের দিনের জন্য। সকাল বেলায় মানুষ ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু যে মানুষটা রাত দুটোয় ঘুমোতে যান তার তো আর স্বাভাবিক সকাল হয়না। তার সকাল হয় দশটা-এগারোটা নাগাদ। আজকাল আমরা সবাই ব্যস্ত। অনেক সময় পার্টি বা কাজের জন্য ঘুমোতে দেরি হয়, টেনশনের কারণে ঘুম আসেনা।ফলে আমাদের শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়।
দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার কারণে বায়োলজিক্যাল ক্লক ও ঘুম ভাঙার মধ্যে একটা অসামঞ্জস্যতা হয় এবং অনেক রকম মেটাবলিক সমস্যা, হরমোনজনিত সমস্যা দেখা দেয়।ফলে নানা রকম রোগ এসেআমাদের শরীরে বাসা বাঁধে যেগুলোকে আমরা লাইফস্টাইল ডিজিজ বলি। যেমন ওবেসিটি, ডায়াবেটিস-প্রেসারেরসমস্যা, অ্যাংজাইটি, দুশিন্তা, ইনসমনিয়া, স্ট্রেসরিলেটেড, স্ট্রোক ইত্যাদি এই জাতীয় সমস্যাগুলো কিন্তু বাড়ছে। শরীরের সমস্ত মেটাবলিক সিস্টেম এবং হরমোনাল সিস্টেম গুলো ঠিকঠাক থাকছেনা।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক মানুষকে বেশি বেশি ঘুমোতে দেখা যায়। যে সময় সাধারণত তার ঘুমোনোর কথা নয়, সেসময়ও ঘুমোচ্ছেন। এর কিছু কিছু কারণ থাকে যার মধ্যে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়া হল অন্যতম।
পলিসোমনো গ্রাফি করার সুবিধা সব জায়গায় পাওয়া যায়না। এমনকী অনেক সময়সরকারি হাসপাতাল গুলোতেও সেসব সুবধা মেলেনা। এই পরীক্ষা খুব খরচ সাপেক্ষ। প্রায়ছ’-সাত হাজার টাকা খরচ হয়। তাই ডাক্তারবাবুরা সবাইয়ের এই পরীক্ষা করান না। ই.এন.টি বিশেষজ্ঞরা রোগী কেস হিস্ট্রি শুনে বুঝতে পারেন কার করানো উচিত। রোগীকে দেখে এবং ক্লিনিক্যালি পরীক্ষাকরে বা বাড়ির লোক বা রোগীর কাছ থেকে সমস্যা ও ইতিহাস শুনে বুঝতে পারেন সমস্যাটা ঠিক কতটা গভীর।
ঘুমের মধ্যে অক্সিজেন স্যাচুরেটেড লেভেল ক্রিটিক্যাল লেভেলের নীচে নেমে যায় কিনা, ই.সি.জি করে দেখতে হয় হার্টরেট খুব ওঠা-নামা করে কিনা। কারণ এর ফলে পরে কার্ডিয়াক সমস্যা হতে পারে। এইসব সমস্যা যদি না থাকে তা হলে অপারেশন করার প্রয়োজন নেই।
অনেক সময় অপারেশনে একটা স্টেজে সাফল্য আসেনা। তখন দুটো স্টেজে করতে হয়। সিভিয়ার কেসে তিনটে স্টেজও লাগতে পারে। তবে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম স্টেজেই সাফল্য মেলে।
তবে এই রোগটা এমন নয় যে চিকিৎসকের কাছে গেলাম, কিছু ওষুধ খেলাম, পুরোফিট হয়ে গেলাম—ব্যাপারটা মোটেই কিন্তু তা নয়। এইসমস্যাটা অনেক দিন ধরে চলার ফলে শরীরে সমস্ত সিস্টেম উল্টো পাল্টা হয়ে যায়। সেই সিস্টেমটা কে ঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রোগীকে সাধারণ জীবন যাত্রায় ফিরিয়ে আনা একটু সময় সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে রোগী ও তার বাড়ির লোকের সহায়তা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রেন রিলেটেড কারণে যে বেশি বেশি ঘুম হয় সেখানে অপারেশনের কোনো ভূমিকা নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আধুনিক কিছু ওষুধ পত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বয়স বাড়লে বেশির ভাগ মানুষের নাক ডাকার প্রবণতা বেড়ে যায়। এর কারণ নাক থেকে ফুসফুস অবধি বাতাস চলাচলের পথে থাকা টিসু গুলো একটু ঢিলে হয়ে যায় এবং কম্পিত হতে থাকে। হঠাৎ করে যদি ওজন বেড়ে যায় অর্থাৎ মাস দুয়েকের মধ্যে যদি পাঁচ-ছ’ কেজি ওজন বেড়ে যায় তখন ওই টিসু গুলোতে চর্বি জমা হয়ে কিংবা পেটের ভুড়িতে যে ফ্যাট জমা হয় তার কারণে চাপ পড়ে এবং বাতাস চলাচলের জায়গাটা সরু হয়ে কম্পন হয় ও নাক ডাকা শুরু হয়।
প্যারামিটারকে অসুবিধায় না ফেলে অর্থাৎদিনেরবেলায় ঝিমোচ্ছেন কিনা, প্রেসার-সুগারের অসুবিধা আছেন কিনা, হঠাৎকরে ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিনা, নাক ডাকার কারণে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, এতটাই নাকডাকছে যে নিজের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসছেন, আবার তারপর শুয়ে পড়ছেন—এইসব লক্ষণ দেখে।
নাক ডাকা মানেই কি অসুখ
নাক ডাকা মানেই যে সবসময় অসুখ বলে ধরে নেওয়া হবে তা কিন্তু নয়।
জীবন শৈলীর পরিবর্তন, ব্যায়াম, স্বাস্থ্যসম্মতখাওয়া, কিছু ওষুধপত্রের ব্যবহারেও যখন ব্যাপারটাকে কমানো যায়না, তখন অস্ত্রোপাচারের প্রয়োজন পড়ে।এছাড়া পলিসোমনোগ্রাফি পরীক্ষার সাহায্যেও বোঝা যায় সমস্যার গভীরতা।রোগীর নাক-কান-গলার, ফ্যারিংস অঞ্চলে কিছু কিছু অংশে সমস্যা থাকে।যার কারণে ঘুমের মধ্যে সঠিক ভাবে শরীরে অক্সিজেন যায় না।এই অক্সিজেন ঠিক মতো না যাওয়ার কারণে গাঢ় ঘুমটা তার কখনোই হয়না।ফলে ঘুমের যে উপকারিতা তা তিনি পাননা।এর জন্য দায়ী শ্বাস নেওয়ার জায়গাটায় কিছু অবরোধ। এই অবরোধ জনিত রোগী অর্থাৎ অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়ার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
হঠাৎহঠাৎঘুম পেয়ে যায় কারো কারো সেন্ট্রাল স্লিপঅ্যাপনিয়ার কারণে মাথায় বিভিন্ন রকম ফেনোমেনা ঘটে ব্রেনের মধ্যে।ফলে ব্রেন হঠাৎকরে ঝিমিয়ে পড়ে।ব্রেনের অ্যালার্ঠনেস কমে যায়।নিউরোট্রান্স মিটার লেভেল ডাউন হয়ে যায়।এরপর যদি হঠাৎকরে কোনো হরমোনাল সিগন্যাল যায় যে শরীর ঘুম চাইছে তাহলে ঘুম পায়।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়া হয় বিভিন্ন কারণে। যেমন নাকের হাড় বাঁকা হতে পারে। নাকের মধ্যে যে মাংস গুলো থাকে ডাক্তারি পরিভাষায় যা কে টারবিনেটটস বলে যা সাধারণ মানুষ পলিপ বলেই জানে, সেই মাংস গুলো বা পলিপ যদি বেড়ে যায়।অ্যালার্জি বেশি থাকলে বা অন্যান্য কারণে পলিপ হতে পারে। ফলে নাকের মধ্যে বাতাস চলাচলের রাস্তা সরু হয়ে যায় এবং যখন সেই রাস্তা নির্দিষ্ট সীমার (ক্রিটিক্যালপয়েন্ট) বাইরে চলে যায় তখন সাধারণ ভাবে নাকের ভিতর দিয়ে শ্বাস যেতেই পারেনা। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে দেখা দেয় ঘুমের মধ্যে ‘হাঁ’ করে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া। ‘হাঁ’ করে শ্বাস নেওয়ার ফলে নাকটার ব্যবহার কম হয়, জায়গায়টা আরও চেপে যায়। ‘হাঁ’ করে শ্বাস নেওয়ার কারণে টনসিল অ্যাডিনয়েড আরো বেড়ে গিয়ে মুখ দিয়েও শ্বাস নেওয়ার অসুবিধা হয়। জিভের পিছনটা বেড়ে যেতে থাকে।ফলে ঘুমের সময় শ্বাস বাধা প্রাপ্ত হওয়ার শরীরে মেটাবলিজম ক্রিয়া কলাপ গুলো থিতিয়ে আসার কথা, রিস্টোর করে শরীরটা কে নতুন করে জাগিয়ে তোলার কথা—সেই জায়গাটার খামতি রয়ে যায়। ফলে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরও শরীর আবার ঘুমের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে—এরা সব সময় বলে, ঘুমটা ভালো হলনা।ফলে কাজে এদের কোনো উৎসাহ থাকেনা, কাজের মধ্যে ঝিমোতে থাকে।সব সময় শুয়ে-বসে থাকতে ইচ্ছে করে।যার সুগার-প্রেসার ছিলনা তার সুগার-প্রেসার বেড়ে যেতে পারে, ওষুধে নিয়ন্ত্রণ হতে চায়না।বন্থু-বান্ধবের সঙ্গে মিশতে ইচ্ছে করেনা, পার্টিতে যেতে ইচ্ছে করেনা, বিবাহিত জীবনে শারীরিক ভাবে মিলিত হতে ইচ্ছে করেনা।এই ধরনের ব্যাপার গুলো ঘটে প্রাথমিক স্তরে কিংবা বেড়ে গেলেও এইসব লক্ষণ দেখা যায়।তবে এদের ওজন কমেনা, অক্সিজেন পুরোপুরি জায়না বলে ক্যালোরি খরচ করার ক্ষমতা কম থাকে, ফলে অল্প খেলেও রোগী মোটা হয়ে যায়।এই সব মানুষদের ওবেসিটি বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছয় যার ফলে যেকোনো সময়ে একটা ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে।ঘুমের মধ্যে কার্ডিয়াক সমস্যা হওয়াটাও বিচিত্র নয়।অনেক ক্ষেত্রে এই সমস্যার কারণে ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হতেও দেখা গেছে।
রোগীর কাজে কর্মে উৎসাহ হারানো, সুগার-প্রেসার বাড়া, থাইরয়েডের সমস্যা বেড়ে যাওয়া, কোনো ওষুধ কাজ না করা, ওজন বেড়ে যাওয়া, কাজকর্মে ভুল, হিসাবপত্রে ভুল, সূক্ষ্ম জিনিস মনে রাখতে পারার সমস্যা, স্মৃতিশক্তি লোপ,ফ্যামিলি লাইফ হ্যাম্পার হওয়া, তার সঙ্গে অ্যারিথমিয়া, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এবং ব্রেনস্ট্রোক হওয়াও বিচিত্র নয়।
সেন্টাল স্লিপঅ্যাপনিয়ায় ওবেসিটি বেশি থাকেনা।নাক-মুখ-গলায়গঠনগত ভাবে অস্বাভাবিকতা কম থাকে।তবুও দেখা যায় রোগীর ঘুম ঘুম ভাব এবং হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
রান্না করতে করতে চোখ লেগে যাওয়ার কারণে গ্যাস থেকে দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়।গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ ঘুমের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।ভালো সাঁতার জানা সত্ত্বেও নদী বা পুকুরে তলিয়ে যেতে পারে এই হঠাৎ ঘুমের কারণে। ছাদে উঠে কাজ কর্ম করতে করতে ঘুমের কারণে ছাদ থেকে পড়ে যেতে পারে। শ্রমিকদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা হলে উঁচু থেকে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঘুম এসে কাজের একাগ্রতা কমিয়ে দেয় বলে এইধরনের দুর্ঘটনা ঘটে।
এইধরনের দুর্ঘটনার কবলে যারা পড়েন তাদের স্টাডি করে ডাক্তার বাবুরা বুঝতে পারেন। অবস্ট্রাকটিভস্লিপঅ্যাপনিয়া যা ব্রেনের কারণে হয় বা একধরনের এপিলেপ্সি অথবা নার্কোলেক্সি দায়ী থাকে।
লক্ষণ বলতে রোগীর যখন ঘুমোনোর কথা নয় তখন ঘুমোনো, কাজে মন বা ইচ্চা না থাকা, মনে না রাখাতে পারা, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা, একা একা থাকতে ইচ্ছে করা ইত্যাদি। এর সাথে সুগার বেড়ে যাওয়া, প্রেসার বাড়া, ওজনবাড়া ইত্যাদি যা ওষুধ খেয়েও নিয়ন্ত্রণ হয়না।
আবার যাদের এসব সমস্যা নেই অর্থাৎ ওজন বেশি নয়, খুব নাক ডাকেন না, সুগার-প্রেসার স্বাভাবিক, থাইরয়েডের কোনো সমস্যা নেই, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনশৈলী, সময় মতো ঘুমোতে যান, তা সত্ত্বেও হঠাৎ হঠাৎ ঘুম এসে যায়, সেক্ষেত্রে ব্রেনের কিছু সমস্যার কথা ভাবতে হবে।
চিকিৎসা
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়ার চিকিৎসা করতে হবে। ই.এন.টি চিকিৎসকদের কাছে এখন অনেক রকম চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, অনেক রকম যন্ত্রপাতি আছে। ফলে যে জায়গায় অবরোধ হচ্ছে সেটা খুলে দেওয়া সম্ভব।এর সাথে রোগীর কিছু কাউন্সেলিং, জীবনশৈলীর পরিবর্তন অর্থাৎ ঠিকঠাক সময়ে খাওয়া, ঘুমোনো, জাঙ্কফুড না খাওয়া, ব্যায়াম করা এগুলোর ওপর নজর দিতে হয়।
প্রত্যেক মানুষেরই পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন।শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোর একটা সময় বিশ্রামের দরকার হয়। আমরা বলি ঘুমোলে শরীর বিশ্রাম পাবে। আসলে তা হয়না। ঘুমের সময় শরীর নিজের মেটাবলিজমকে রি-অর্গানাইজড করে পরের দিনের জন্য। সকাল বেলায় মানুষ ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু যে মানুষটা রাত দুটোয় ঘুমোতে যান তার তো আর স্বাভাবিক সকাল হয়না। তার সকাল হয় দশটা-এগারোটা নাগাদ। আজকাল আমরা সবাই ব্যস্ত। অনেক সময় পার্টি বা কাজের জন্য ঘুমোতে দেরি হয়, টেনশনের কারণে ঘুম আসেনা।ফলে আমাদের শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়।
দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার কারণে বায়োলজিক্যাল ক্লক ও ঘুম ভাঙার মধ্যে একটা অসামঞ্জস্যতা হয় এবং অনেক রকম মেটাবলিক সমস্যা, হরমোনজনিত সমস্যা দেখা দেয়।ফলে নানা রকম রোগ এসেআমাদের শরীরে বাসা বাঁধে যেগুলোকে আমরা লাইফস্টাইল ডিজিজ বলি। যেমন ওবেসিটি, ডায়াবেটিস-প্রেসারেরসমস্যা, অ্যাংজাইটি, দুশিন্তা, ইনসমনিয়া, স্ট্রেসরিলেটেড, স্ট্রোক ইত্যাদি এই জাতীয় সমস্যাগুলো কিন্তু বাড়ছে। শরীরের সমস্ত মেটাবলিক সিস্টেম এবং হরমোনাল সিস্টেম গুলো ঠিকঠাক থাকছেনা।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক মানুষকে বেশি বেশি ঘুমোতে দেখা যায়। যে সময় সাধারণত তার ঘুমোনোর কথা নয়, সেসময়ও ঘুমোচ্ছেন। এর কিছু কিছু কারণ থাকে যার মধ্যে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপঅ্যাপনিয়া হল অন্যতম।
পলিসোমনো গ্রাফি করার সুবিধা সব জায়গায় পাওয়া যায়না। এমনকী অনেক সময়সরকারি হাসপাতাল গুলোতেও সেসব সুবধা মেলেনা। এই পরীক্ষা খুব খরচ সাপেক্ষ। প্রায়ছ’-সাত হাজার টাকা খরচ হয়। তাই ডাক্তারবাবুরা সবাইয়ের এই পরীক্ষা করান না। ই.এন.টি বিশেষজ্ঞরা রোগী কেস হিস্ট্রি শুনে বুঝতে পারেন কার করানো উচিত। রোগীকে দেখে এবং ক্লিনিক্যালি পরীক্ষাকরে বা বাড়ির লোক বা রোগীর কাছ থেকে সমস্যা ও ইতিহাস শুনে বুঝতে পারেন সমস্যাটা ঠিক কতটা গভীর।
ঘুমের মধ্যে অক্সিজেন স্যাচুরেটেড লেভেল ক্রিটিক্যাল লেভেলের নীচে নেমে যায় কিনা, ই.সি.জি করে দেখতে হয় হার্টরেট খুব ওঠা-নামা করে কিনা। কারণ এর ফলে পরে কার্ডিয়াক সমস্যা হতে পারে। এইসব সমস্যা যদি না থাকে তা হলে অপারেশন করার প্রয়োজন নেই।
অনেক সময় অপারেশনে একটা স্টেজে সাফল্য আসেনা। তখন দুটো স্টেজে করতে হয়। সিভিয়ার কেসে তিনটে স্টেজও লাগতে পারে। তবে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম স্টেজেই সাফল্য মেলে।
তবে এই রোগটা এমন নয় যে চিকিৎসকের কাছে গেলাম, কিছু ওষুধ খেলাম, পুরোফিট হয়ে গেলাম—ব্যাপারটা মোটেই কিন্তু তা নয়। এইসমস্যাটা অনেক দিন ধরে চলার ফলে শরীরে সমস্ত সিস্টেম উল্টো পাল্টা হয়ে যায়। সেই সিস্টেমটা কে ঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রোগীকে সাধারণ জীবন যাত্রায় ফিরিয়ে আনা একটু সময় সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে রোগী ও তার বাড়ির লোকের সহায়তা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রেন রিলেটেড কারণে যে বেশি বেশি ঘুম হয় সেখানে অপারেশনের কোনো ভূমিকা নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আধুনিক কিছু ওষুধ পত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন