পেট ব্যথা নিয়ে কেন এত চিন্তা
ডাঃ কিংশুক দাস
2019-01-28 11:01:29

অসুস্থতা-১
সোমবার সন্ধেবেলায় চেম্বারে সবে বসেছি, এক সুন্দরী তন্বী দরজা ঠেলে বলে উঠল, ‘স্যার, আসতে পারি’? চিনতে আমার একদমই অসু্বিধে হল না। গিরিশবাবুর একমাত্র মেয়ে শৃন্বন্তী। কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব উদ্বিগ্ন। ও বলে উঠল, দেখুন না বাবার পেটে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে। এক সেকেন্ডেই আমার মাথায় এল, মেসোমশাইয়ের কি তবে প্যাংক্রিয়াটাইটিস হয়েছে! শৃন্বন্তী যখন সেই ছোট্টটা ছিল তখন থেকেই গিরিশবাবুর একটু মদ্যপানের অভ্যাস। গিরিশবাবুকে দেখে এবং কতকগুলো রক্ত পরীক্ষা করিয়ে আমার করা অনুমানই সত্যি হল।
অসুস্থতা-২
বাঁশদ্রোণীর বিকাশবাবু। বহুদিনের রোগী। ওর সমস্যা—গ্যাস হয়। কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। যখন উনি খুব চিন্তা করেন—পারিবারিক, অর্থনৈতিক কিংবা অফিস সংক্রান্ত তখন ওনার শারীরিক সমস্যা আরও বেড়ে যায়। ওষুধ খান, কাজও দেয়। আবারও রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। বিকাশবাবুর ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম হয়েছে। সমস্যাটা হয়তো সারাজীবন চলবে।
অসুস্থতা-৩
শ্যামবাজারের শ্যামলী-দেবী সেদিন চেম্বারে এসে বললেন, ডাক্তারবাবু গত দু’মাস ধরে লিভারে ব্যথা হচ্ছে। ডানদিকে ওপর পেটেই তিনি ব্যথা অনুভব করছেন। ডায়াগনোসিস করে দেখা গেল শ্যামলীদেবীর পেটের ব্যথার কারণ তার গলব্লাডারে স্টোন। বুঝেতেই পারছেন, ডানদিকের ওপর পেটে ব্যথা মানেই লিভারের ব্যথা নয়।
অসুস্থতা-৪
চার বছরের ছোট্ট সোনা সহেলী। থাকে গড়িয়ায়। বেশি মিষ্টি ফুটফুটে দেখত। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওর স্কুল থেকে বাবা-মাকে ডেকে পাঠালেন মিস। অলোকবাবু আর অসীমা দেবী তো সংসারের সব কাজ ফেলে স্কুলে গিয়ে দেখলেন সহেলী তলপেটের ডানদিকে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। একটুও দেরী না করে সোজা কাছের হাসপাতালে। ততক্ষণ সহেলী বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। ওখানকার ডাক্তারবাবুর পরামর্শে অপারেশনের সিদ্ধান্তই নিল ওরা। ছুরি কাঁচি সহযোগে সার্জেন অনেকক্ষণ ব্যস্ত থাকার পর ওটি থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ও অ্যাকিউট অ্যাপেন্ডিসাইটিসের শিকার। এখন বিপদ মুক্ত। আসলে ছোট্ট সহেলী বুঝতেই পারেনি যে ওর পেটের ব্যথাটা প্রথম ওপরের পেটে শুরু হয়েছিল তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
অসুস্থতা-৫
নাকতলার নুপুরদি যখনই আসেন আমার চেম্বারে সেই একই কথা। গ্যাস হয়েছে, চোঁয়া ঢেঁকুর, পেট পরিষ্কার হয়নি কিংবা খিদে পায় না। নুপুনদি বারেবারেই বলেন আমার এই গ্যাস শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নড়েচড়ে বেড়ায়। কখনো বুকে কখনো পিঠে। আবার কখনো ডান পাঁজরের নীচে কখনো বা পাঁজরে। আবার কখনো মাথায় গ্যাসটা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। কখনও গ্যাসটা ওপরের দিকে ঠেলে ওঠে, আবার কখনো তা নীচের দিকে নির্গত হয়। কখনো পেটটা ভার হয়ে যায়। মোদ্দা কথা সব মিলিয়ে বেশ গন্ডগোলে ব্যাপার। আসলে নুপুরদি ভুগছেন একটা মিশ্র রোগে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে নন-আলসার ডিসপেপসিয়া আর ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম। এই দুই রোগের আক্রমণে উনি একেবারেই বিপর্যস্ত। ডাক্তারি শাস্ত্রে ডানদিকে গ্যাস আটকে থাকলে বলে হেপাটিক ফ্লেকসার সিনড্রোম, আর বাঁদিকে গ্যাস আটকে থাকলে বলে স্প্লিনিক ফ্লেকসার সিনড্রোম।
পেট ব্যথা নিয়ে এত চিন্তা কেন
ওপরের যে পাঁচটি অসুস্থতার কথা বলা হল তা ভালোভাবে পড়লে এটাই বোঝা যায় যে সবাই পেটের ব্যথার ভুগছেন। এতে কোনো দ্বিমত নেই। আর পেট ব্যথা হল একটা আনপ্লিজ্যান্ট সেনসেশন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ব্যথার মাত্রার পরিবর্তন ঘটে। নানান রোগী নানান ভাবে বলেন। কেউ বলেন পেটে কামড় দিচ্ছে, কেই বা বলেন পেটে জ্বালা করছে, কেউ বলেন পেটে কে যেন সুঁচ ফোটাচ্ছে। আসলে সব ধরনের পেট ব্যথাই নির্দেশ করে একটা ইনজুরিকে যা হয়তো কোনো কলাতে সাংঘাতিক হয়েছে। অথবা আমাদের ব্রেন স্টিমুলেশনের পরিবর্তন হওয়ার কারণে অন্য কোনো স্টিমুলেশনেকে পেন বা ব্যথা বলে ভুলে করে।
ব্যথার প্রকারভেদ
পেট ব্যথাকে প্রধানত দু’ ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমটা হল—অ্যাকিউট অর্থাৎ যা হঠাৎ করে শুরু হয়। এবং দ্বিতীয়টা হল ক্রনিক, যা মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর চলতে থাকে।
আমরা ডাক্তারবাবুরা অবশ্য অ্যাকিউট পেট ব্যথাকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালেো আগে হঠাৎ করে পেটে ব্যথা হলেই আমরা ভাবতাম এটা হয়তো সার্জিকাল কন্ডিশন। তবে বর্তমানে উন্নত মেডিকেল সায়েন্সর জন্য সবসময় অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে না। অপারেশন না করেও সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা সম্ভব। তবে এটাও বলি ক্রনিক পেট ব্যথাকেও অবহেলা করবেন না। পরিস্থিতি অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অভশ্যই নেবেন।
একটু ইতিহাস
আদিম যুগের মানুষরা কিন্তু জানত না কোনটা খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো বা খারাপ। এটা না জানলেও একটা বিষয়ে তাদের জ্ঞান বেশ টনটনে ছিল। তারা বুঝতে পারত ঠিক কোন খাবারটা খেলে তাদের শরীর খারাপ হতে পারে। আর যখনই কোনো বাধার সৃষ্টি হত তখন ওরা তার দায়টা চাপিয়ে দিত ‘এভিল স্পিরিট’ বা দুষ্ট আত্মাদের ওপর। অর্থাৎ ভগবানের অসহযোগিতা ও দুষ্ট আত্মাদের ষড়যন্ত্রের কারণেই এই সমস্ত ঘটনা ঘটছে। আর ৪৬০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে জন্মেছিলেন হিপোক্রিটিস। তিনি কিন্তু কোনোরকম সংস্কারের জালে আটকে না থেকে রোগীর লক্ষণ বা উপসর্গগুলোকে ধরে ধরে বর্ণনা করেন।
তিনি চারটি উপাদানকে বেশি করে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেগুলো হল—হলুদ পিত্তে, ফ্লেম, রক্ত এবং কালো পিত্ত। মজার ব্যাপার হল এই চারটি উপাদানের মধ্যে যোগাযোগের অভাব ঘটলেই রোগ দেখা যায়। এমনই ছিল ওনার ধারণা। পিত্ত বেশি হলে সে যুগে বাঁধাকপি আর পাতলা মধু দিয়ে চিকিৎসা করা হত। ইজিপ্টিয়ান মেডিসিনের প্রধান ডকুমেন্ট Ebres Papyrus (১৫৫২ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ)-এ পনেরো রকম পেটের রোগের উল্লেখ আছে। যার মধ্যে পেটের ব্যথা, কৃমি ও ল্যাক্সেটিভস অন্যতম।
১৪০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে ইজিপ্টে পাথরভর্তি গলব্লাডারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বুক জ্বালা, ঢেঁকুর ওঠা এবং খিদে পেলে যে ওপরের পেটে ব্যথা করে তার উল্লেখ পাওয়া যায় ৩৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। গ্রিক সার্জেন হিরোকিলাস মৃত ব্যক্তির পৌষ্টিকতন্ত্র জনসমক্ষে ব্যবচ্ছেদ করেন প্রায় ৩০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের কাছাকাছি। তিনি ডিওডিনামের নামকরণও করেন। যার দৈর্ঘ বারো আঙুল। গ্যালেন প্রখর বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। সবকিছু তিনি যুক্তি দিয়ে বিচার করতেন এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে যেকোনো অন্ধ বিশ্বাসকে খন্ডন করতেন। তাঁর ডায়াগনোসিস ছিল অভ্রান্ত। গ্যালেনই প্রথম পেটে হাত দিয়ে চিকিৎসা পদ্ধতির যৌক্তিকতা এবং উপযুক্ততা প্রমাণ করেন। তিনি এটাও বলেন যে অন্ত্রের নিম্নাংশও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং মলের রঙ ও প্রকৃতি রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে। আজকাল যে বলা হচ্ছে টেনশনের জন্যও পেটের অসুখ হয় এমন সিদ্ধান্তের আবিষ্কর্তা কিন্তু গ্যালেনই। আসলে তখনকার চিকিৎসকরা উপসর্গগুলোকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে নিরুপণ করার কৌশল না জানলেও পর্যবেক্ষণ দ্বারা অনুমান করে নিতেন রোগ বিষয়ে। বিশেষত দুটি উপায়ে চিকিৎসাকার্য সম্পাদন করা হত। মনে করা হত যে হয় রক্ত দূষিত আছে নতুবা পেটেই সমস্ত খারাপ জিনিস জমা হয়ে আছে। সুতরাং ওষুধের মাধ্যমে পেট পরিষ্কার করে দিলেই সুরাহা মিলবে। রোগীও আরাম পাবে। তারপর অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকে এই ধারণার ওপর বিজ্ঞানমনস্কতার ছাপ পড়ল। নিউরো ভাসকুলার সিস্টেম টেনশনের কারণেই যে কোনও রোগের উৎপত্তি তা জানা যায়। তার মধ্যে পেট ব্যথাও অন্যতম। গ্যাসট্রো-এন্টারোলজির সঠিক ধারণা তখন থেকেই দানা বাঁধতে থাকে। আরো একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করা দরকার। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউনিভার্সিয়া মেডিসিনা গ্রন্থে অ্যাকিউট অ্যাপেন্ডিসাইটিসের কথা বলা হয়েছিল। যদিও তার সবিস্তার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে।
ব্যথার ভিতরের কথা
এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করার আগে আমরা একটু অ্যানাটমিটা বুঝে নেওয়ার চেষ্ট করব। পেটে অনেকগুলো অর্গান অবস্থান করে। পাকস্থলি, লিভার, গলব্লাডার, পিত্তনালী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র ইত্যাদি প্রত্যঙ্গকে আমরা ব্যাপক অর্থে ভিসেরাল অর্গানস বলতে পারি। আর পেটের ভিতরটা তো একটা থলির মতো। তাই একে আমরা বলতে পারি পেরিটোনিয়াল ক্যাভিটি। অর্থাৎ ভিসেরাল অর্গানগুলো পেরিটোনিয়াল ক্যাভিটির ভিতর অবস্থিত।
আমরা যখর কমলালেবু খাওয়ার জন্য খোসা ছাড়াই তখন একটা পাতলা আবরণ দেখতে পাই। এখানেও ঠিক সেইরকম একটা আস্তরণ বা কভারেজ এই ভিসেরাল অর্গানগুলোকে ঢেকে রেখেছে। যার ডাক্তারি নাম পেরিটোনিয়াম। সুতরাং পেটের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে সৃষ্টি হওয়া ব্যথাকে আমরা বলতে পারি ভিসেরাল পেন।
এই ইনটেস্টিনাল বা ভিসেরাল অর্গানগুলো ভিসেরাল নার্ভ ফাইবার দ্বারা স্পাইনাল কর্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কিন্তু এই স্পাইনাল কর্ড থেকে তো আরও অনেক নার্ভ বেরিয়ে এসেছে। সুতারং একই জায়গা থেকে ওভারল্যাপিংয়ের সমস্যা দেখা যায়। একটা উদাহরণ তুলে ধরলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। অ্যাপেন্ডিসাইটিস হলে নাভির চারপাশে ব্যথা করে। আর পরের দিকে তলপেটের ডানদিকেও সেই ব্যথা ধরতে পারা যায়। আসলে স্পাইনাল কর্ডের T10 থেকে একই সঙ্গে অ্যাপেন্ডিক্সের নার্ভ ও নাভির চারপাশের চামড়ার নার্ভ নির্গত হয়েছে। এখন ওভারল্যাপিং হওয়ার ফলেআমাদের মস্তিষ্ক ব্যথাটাকে নাভির চারপাশে ধরতে সক্ষম হয়। এখানে বলে রাখা ভালো সোমাটোপ্যারাইটাল পেইন বা চামড়ার ব্যথাকে আমরা সহজেই অনুভব ও নির্দিষ্ট করতে পারি। তা যে ব্যথাই হোক না কেন। কিন্তু ভিসেরাল অর্গানদের কাট-সেনশন নেই। একটু পরিষ্কার করে বললেই বোঝা যাবে। চিরে দিলে বা কেটে দিলে বা পিষে দিলে বা চেপে দিলে তারা সেই বোধকে সঞ্চারিত করতে পারে না। আর ঠিক সেই কারণে পাকস্থলির বায়োপসি নেওয়ার সময় রোগী কিন্তু টের পান না। আর এন্ডোস্কোপি করলেও একই ব্যাপার। অর্থাৎ রোগী তা টের পাবেন না। কিন্তু সে তুলনায় চামড়ার স্নায়ুগুলোর সংবেদনমীলতা পরিবহন করার ক্ষমতা যথেষ্ট বেশি। সুতরাং নাভির চারপাশের চামড়ায় ব্যথাটাকে নির্দিষ্ট করতে পারাটা মস্তিষ্কের পক্ষে সহজসাধ্য।
যেখান থেকে যে ধরনের স্টিমুলেশন অ্যারাইজ করে তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় রিসেপ্টর বলে। আর এই ধরনের রিসেপ্টর আমাদের শরীরে চারদিকে ছড়িয়ে আছে। ভিসেরাল অর্গানদের কাট-সেনশন নেই সেকথা আগেই বলেছি। তাহলে এখন কী জাতীয় ব্যথায় আমাদের ভিসেরাল অর্গানগুলো সাড়া দেয়? আর স্টিমুলেশন মাত্রাতিরিক্তি হলে সেই স্ট্রেচটাই ব্যথাতে প্রতিফলিত হয়। যার ফলে খাদ্যনালীতে খাবার আটকে গেলে আমরা অনুভব করতে পারি। আর অ্যাপেন্ডিক্স যখন ফেটে যায় তখন একজাতীয় প্রবল ব্যথা আমরা অনুভব করি। আসলে অ্যাপেন্ডিক্স ফেটে গেলে পুঁজ হোক বা স্টুল ম্যাটার হোক ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সহজেই আমাদের পেরিটোনিয়াম ইনভলভড হয়ে পড়ে। আর তার সঙ্গে চামড়ার সংযোগ থাকায় ব্যথাটাও বিস্তারিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
শেষে বলব রেফারড পেইন। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। ডায়াফ্রাম আমাদের ছোট্ট ক্যাভিটি আর অ্যাবডোমেনকে পৃথক করে রাখে। সেই ডায়াফ্রামের তলায় থাকে গলব্লাডার। এখন গলব্লাডার সংক্রামিত হলে ডায়াফ্রামও সংক্রামিত হয়। আর ডায়াফ্রামের নার্ভ সাপ্লাই ও কাঁধের চামড়ার নার্ভ সাপ্লাই একই সেগমেন্ট (C5) থেকে হওয়ার দরুন আক্রান্ত ব্যক্তি কাঁধে ব্যথা অনুভব করেন। রোগ কিন্তু গলব্লাডারে।
আসলে আমাদের অ্যাবডোমেন বা পেট হল একটা ম্যাজিক বক্স। এতগুলো প্রত্যঙ্গ এত বিচিত্র উপায়ে একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এদের কার্যকলাপ এতই বৈচিত্রময় যা কিনা ডাক্তারবাবুর সাহায্য ছাড়া কোনো কিছুই অনুমান করা যথেষ্ট মুশকিল কাজ।
কীভাবে ব্যথা হয়
একটা রেখচিত্রের সাহায্যে আপনাদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরা হল—
রিসেপ্টর পেরিফেরাল নার্ভ মেরুদন্ড স্পাইনো থেলামিক ট্রাক ব্রেনের সোমাটো সেনসরি কর্টেক্স লিম্ফিক সিস্টেম মোটর কর্টেক্স
রিসেপ্টর থেকে ব্যথা পেরিফেরাল নার্ভের সাহায্যে মেরুদন্ড এসে উপস্থিত হয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে স্পাইনো থেলামিক ট্র্যাক, ব্রেনের সোমাটো সেনসরি কর্টেক্স হয়ে লিম্ফিক সিস্টেমে পৌঁছয়। এই লিম্ফিক সিস্টেম ব্যথাটাকে অ্যানালাইজ করে ও তারপর তাকে পাঠিয়ে দেয় মোটর কর্টেক্স। যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ব্যথাকে আদৌ প্রকাশ করা হবে কি না বা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে।
পেট ব্যথার নির্ধারক কী কী
নেচার অফ স্টিমুলাই, টাইট অফ রিসেপ্টর, নিউরাল পাথওয়ে ইত্যাদি ফ্যাক্টরগুলোর ওপর পেট ব্যথার স্বরূপ নির্ভর করে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হল রোগীর সাইকো সোস্যাল অ্যাটমোস্ফিয়ার। অর্থাৎ রোগী কোন সমাজের অন্তর্ভক্ত কিংবা তার ব্যক্তিত্ব কেমন ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের মাথায় রাখতে হয়। একজন পরিশ্রমী চাষী যখন পেট ব্যথায় কাতরায় তখন আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে ব্যথাটা সত্যিই মারাত্মক।
ব্যথা কোথায় হতে পারে
ভিসেরাল পেন সর্বদাই শরীরের মিডলাইন বরাবর প্রতিক্রিয়া জানায়। সুতরাং কোথায় ব্যথা হলে কী জাতীয় অঙ্গ জড়িত থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারা ডাক্তারবাবুর পাশাপাশি রোগীর পক্ষেও আবশ্যক। নাভির ওপর পেটে ব্যথা হলে তা লিভার, পাকস্থলি, অগ্ন্যাশয় বা ক্ষুদ্রান্ত্রে হতে পারে। নাভির চারপাশে ব্যথা হলে তা হতে পারে জেজুনাম, ইলিয়াম, অ্যাপেন্ডিক্স, সিকাম, অ্যাসেন্ডিং কোলন ইত্যাদি স্থানে। আর তলপেটে ব্যথা হলে বুঝতে হবে যে কিডনি, কোলন, ইউরিনারি ব্লাডার, ইউরেটার বা গাইনোকোলজিক্যাল অর্গানস আক্রান্ত হয়েছে। আর ব্যথা বাঁদিকে থেকে ডানদিকে বা অন্য কোথাও সরে এলে বুঝতে হবে তা পেরিটোনিয়ামকে আক্রান্ত করেছে।
চলুন যাই রোগীর বাড়ি
এক্ষেত্রে আমরা প্রথমে অ্যাকিউট পেন নিয়ে আলোচনা করব। সমস্ত বিজ্ঞ চিকিৎসক সবথেকে আগে ক্রোনোলজি বিষয়ে পরিষ্কার হয়ে যেতে চান। অর্থাৎ ব্যথাটা কীভাবে শুরু হয়েছিল, কতক্ষণ চলেছিল, কীভাবে তার উপশম ঘটল এবং আবারও ফিরে এল কি না ইত্যাদি তথ্যগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে ডাক্তারবাবুরা একটা ক্রোনোলজি নির্মাণ করে নেন। এটা চিকিৎসার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে তৎক্ষণাৎ পেটের ব্যথার ক্ষেত্রে রোগী নিজেও সচেতন থাকেন যে কীভাবে বা কতক্ষণ তাঁকে ভুগতে হয়েছিল, সে বিষয়ে।
আমরা কিন্তু ব্যথার লোকেশন নিয়ে আগেই বলেছি। কোথায় ব্যথা হলে কী কী অঙ্গ তার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে সেটা তুলে ধরাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল। একটা-দুটো উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। গলব্লাডারের ব্যথা ওপরের পেটের মাঝখানে হয়। ব্যথার তীব্রতা এবং চরিত্র প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়।
কখন ব্যথা বাড়ে কখন কমে
অনেক সময় আমরা দেখি পেট ব্যথা চলাকালীন কিছু খেলেই ব্যথা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। আবার অনেকসময় কিছু খেলেই ম্যাজিকের মতো ব্যথা কমে যায়। সুতরাং এগুলো সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধরাণা থাকা দরকার। খাবার খেলে গ্যাস্ট্রিক আলসারের ব্যথা সাধারণত বৃদ্ধি পায়। আর ডিওডেনাল আলসারের ব্যথা সাধারণত খাবার খেলে কমে যায়। ইনটেস্টিনাল অ্যানজাইনাতেও খাবার খেলে ব্যথা বাড়তে পারে। গলব্লাডারের ব্যথা ফ্যাটি ফুড খেলে বাড়তে পারে। শারীরিক অবস্থানও ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। যেমন দেখা যায় প্যানক্রিয়াটাইটিসের ব্যথাতে সামনে ঝুঁকে থাকলে আরাম হয়। কিন্তু আবার সোজা হয়ে শুয়ে থাকলে সেটা বেড়ে যেতে পারে।
আনুষঙ্গিক লক্ষণ
যখন রোগীর পেট ব্য্যথা হয় তখন তার সমগ্র স্বাস্থ্য সম্পর্কেও একজন ডাক্তরকে অবহিত থাকতে হবে। যেমন ওপরের পেটে ব্যথা ও তার সঙ্গে রক্তবমি হলে বুঝতে হবে পেপটিকে আলসার হয়েছে। যেমন ইউরিনারি ট্র্যাকে কোনো সমস্যা হলে দেখা যায় প্রস্রাব করার সময় জ্বাল হয়, রক্ত পড়ে, জ্বর হয়। পেট ব্যথাও হয়। আর পেটে ব্যথা, জনডিস ও জ্বর হলে বুঝতে হবে লিভার বা গলব্লাডারে গন্ডগোল আছে। খিদে কমে গেছে, ওজন কমে গেছে। সঙ্গে পেট ব্যথা হতে পারে। যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে গ্যাস্ট্রো-পোরোসিস। আর বিদেশে জিনগত কারণে সিকল অ্যানিমিয়া নামক রক্তের রোগ দেখা যায়। তার ফলেও পেট ব্যথা হয়।
কোন জায়গায় পেট ব্যথা কোথায় হচ্ছে
আমাদের আলোচনার মধ্যে এটাও কিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পেটের ব্যথা শরীরের অন্য কোন অঙ্গে চলে যায় তার কারণটা আমরা আগেই অ্যানাটমি ধরে বুঝে নিয়েছি। এবার সংক্ষেপে স্থানগুলোকে চিহ্নিত করব। যেমর ওভারি বা ইউটেরাসের ব্যথা আপার থাইয়ে হয়। প্যাংক্রিয়াটাইটিসের ব্যথা পিঠের মাঝখানে (Mid Back) চলে যেতে পারে। এরকম আরো আছে। সুতরাং প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলে ভালো হয়।
পিরিয়ড চলাকালীন
হ্যাঁ, এই সময়টা মেয়েদের পক্ষে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত পিরিয়ড চলাকালীন নানাবিধ প্রতিকূলতা দেখা যায়। অনেক সময় পেট ব্যথাও হতে পারে। পেলভিক এন্ডোমেট্রিওসিস বলে একটি রোগ আছে যার জন্য অনেক সময় পিরিয়ড চলার সময় ব্যথাটা সমানুপাতে বৃদ্ধি পায়। আর পিরিয়ড হলেই অনেক ‘ডাল পেন’ পেটে অনুভব করেন। গর্ভাবস্থার জন্য হয়তো কোনো মহিলা একটা পিরিয়ড মিস করেছেন। পরের মাসে হঠাৎ তিনি একটি প্রবল ব্যথার সম্মখীন হতে পারেন। বলে নেওয়া ভালো, এই ব্যথাটা কিন্তু পেটেই হবে। আমাদের ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে রাপচার এক্টাপিক প্রেগনেন্সি।
ক্রনিক পেট ব্যথা হলে
পৃথিবীর পাঁচ থেকে পঁচিশ শতাংশ মানুষ এই ক্রনিক পেট ব্যথাতে ভোগেন। আর ক্রনিক পেট ব্যথাতে ভোগেন। আর ক্রনিক পেট ব্যথাকে আমরা মূলত দুভাগে ভাগ করি।
- ক্রনিক কনস্ট্যান্ট—যেমন ম্যালিগন্যান্সি, ক্রনিক প্যাংক্রিয়াটাইটিস, ক্যানসার বা কোনও ধরনের মানসিক চাপ ইত্যাদি।
- ইন্টারমিটেন্ট—এর মধ্যে হল ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম, নন আলসার ডিসপেপসিয়া, ইনটেস্টিনাল অ্যাঞ্জাইনা, পার্সিয়াল ইনটেস্টিনাল অবস্ট্রাকশন, গলস্টোনের ব্যথা ইত্যাদি।
কী কারণে পেট ব্যথা
অ্যাকিউট পেট ব্যথার কয়েকটি কমন ও আনকমন কারণ আছে। অ্যাকউট পেট ব্যথা নানা কারণেই হতে পারে। তবে সাধারণ কারণ হল—গলস্টোন, পেপটিক আলসার, প্যাংক্রিয়াটাইটিস, অ্যাপেন্ডিটাইটিস, কৃমি, খাবার বিষক্রিয়া ইত্যাদি।
এবার কয়েকটি আনকমন কারণের উদাহরণ বলি। ক্রোনস ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস, ইনটেস্টিনাল টিউবারকুলোসিস এই গোত্রে পড়বে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত অভিমতই এ রোগ নির্ধারণে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তবে এই শ্রেণী বিভাজনটা রোগীর জেনে রাখা লাভজনক। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো শিশু ও বয়স্কদের পেটে হঠাৎ ব্যথা শুরু হলে অবশ্যই বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।
অ্যাকিউট পেট ব্যথাকে আবার প্রকৃতিগতভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক, পেটের সমস্যার জন্য পেট ব্যথা করছে। এবং দুই, পেট ব্যথা করছে কিন্তু কারণটা পেটের বাইরে।
পেটের সমস্যার জন্য পেট ব্যথা করছে, তার কারণগুলো হল—
- প্যারাইটাল পেরিটোনিয়াম ইনফ্লামেশন (যেমন অ্যাপেন্যিক্স ফেটে যাওয়া, গলব্লাডার ফেটে যাওয়া, পেপটিক আলসার পারফোরেশন, প্যাংক্রিয়াটাইটিস প্রভৃতি)।
- মেকানিক্যাল অবসস্ট্রাকশন অফ হলো ভিসেরা (স্মল বাওয়েল অবস্ট্রাকশন ও লার্জ বাওয়েল অবস্ট্রাকশনের অন্তর্গত)।
- বাইল ডাক্ট অবস্ট্রাকশন।
- ইউরেটারি অবস্ট্রাকশন।
- এম্বেলিজম বা থ্রম্বোসিস (মেসেনট্রিক ইসকেমিয়া, অ্যাওটিক অ্যানুরিজম রাপচার এর উদাহরণ)।
- অ্যাবডোমিনাল ওয়ালে কোনো সমস্যার কারণে পেট ব্যথা হতে পারে। যেমন মাসলে হেমাটোমা, চোট পাওয়া। নার্ভ এনট্র্যাপড হয়ে গেলেও তা হতে পারে।
- ডিসটেনশন অফ ভিসেরাল সারফেসেস (যেমন লিভার বড় হয়ে যাওয়া)
- সংক্রমণ বা ইনফেকশন (স্যালমোনেলা বা সিগেলা জাতীয়)।
- কৃমি থাকার কারণেও ব্যথা হতে পারে।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সচেতনতা ভীষণ কম। তাই যাদের কৃমির ধাত আছে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যথেষ্ট সতর্কতা গ্রহণ করেন না। তাদের কিন্তু প্রতি তিন মাস অন্তর নিয়ম করে কৃমির ট্যাবলেট খাওয়া উচিত। যারা এই সমস্যায় আক্রান্ত নন তারাও এই নিয়মে মেনে চলতে পারেন।
বিজ্ঞানের ভূমিকা রোগ নির্ণয়ে
কিছুক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুরা কয়েকটি বিশেষ পরীক্ষার সাহায্যে অর্থাৎ বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পেট ব্যথার আসল কারণটি উপলব্ধি করতে পারেন।
- রক্ত পরীক্ষা কিছু ক্ষেত্রে ভীষণভাবে ফলপ্রসূ হয়।
- প্যাংক্রিয়াটাইটিসে লাইপেজ বেড়ে যায়।
- গলব্লাডার, পিত্তনালী ও লিভারের রোগে অ্যালকালাইন ফসফাটেজ, এস.জি.পি.টি (এ.এল.টি), বিলিরুবিন ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়।
- আবার কখনো কখনো আলট্রাসনোগ্রাফির সহায়তা নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আলট্রাসনোগ্রাফির সাহায্যে পিত্তনালী, গলব্লাডার ও কিডনির পাথর, অ্যাবডোমিনাল টিউমার, পেটে জল জমা, এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি ইত্যাদি রোগ সহজেই ধরা পড়ে।
- পেটের এক্সেরে ইনটেস্টাইনের অবস্ট্রাকশন ও পেপটিক আলসার অপারেশন করতে সাহায্য করে।
- পেপটিক আলসার ধরা যায় এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে।
- এছাড়া সিটি স্ক্যান ও বেরিয়াম এক্স-রে নানা কাজে ব্যবহৃত হয়।
পরিবর্তন করতেই হবে কয়েকটি ভূল ধারণায়
প্রথমত, অনেকেই ডাক্তারবাবুর কাছে বলেন আমার গ্যাস মাথায় উঠে যায়। অনেক সময় সারা শরীরে যেন ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এরকম হওয়া একদমই সম্ভব নয়। জানেন তো, ইনটেস্টাইন থেকে শরীরের অন্যান্য জায়গায় গ্যাস পরিবহনের কোনো মাধ্যম নেই! তাছাড়া প্রত্যেক মানুষের ইনটেস্টাইনে ১০০ থেকে ২০০ মিলি গ্যাস থাকে। মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষের এর থেকে বেশি গ্যাস হয়। আসলে গ্যাস হলে কিছু অটোনোমিক সিম্পটম দেখা দেয়। যেমন বুক ধড়ফড় করা, পালস রেট বেড়ে যাওয়া, হাত-পা ঘেমে যাওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা ইত্যাদি। রোগীর বলেন সারা শরীর যেন কেমন ‘আনচান’ করতে থাকে। তাদের উদ্দেশ্যে আবারও বলি গ্যাস একস্থান থেকে অন্যত্র পরিবাহিত হয়ে এগুলো ঘটায় না।
দ্বিতীয়ত, অনেকেরই অভিযোগ, যা খাই তাই পেট ব্যথা তৈরি করে। এরকম ভূল ধারণা নিয়ে অনেকেই বেঁচে আছেন। কিন্তু এর জন্য খাবার দায়ী নয়। মাস্টসেল ভেঙে গিয়ে এসব কান্ড ঘটায়।
তৃতীয়ত, সব পেট ব্যথাতেই এনজাইম এবং র্যানিটিডিন বা ফ্যামোটিডিন জাতীয় ওষুধ কাজ দেবে, এটাও একটা ভূল ধারণা। র্যানিটিডিন কম্পোজিশনের ওষুধ মূলত পেপটিক আলসারে কাজ দেয়। অথচ কিছু নির্দিষ্ট পেপটিক আলসারে কাজ দেয়। অথচ কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগীরই এ কারণে পেট ব্যথা করে। সুতরাং বাকিদের পেট ব্যথার উপলক্ষ্যটাকে খুঁজে বার করা উচিত।
চতুর্থত, ডানদিকের ওপরের পেটে ব্যথা হলে অনেকেই ভাবেন তাদের ‘লিভারটা খারাপ’। ডানদিকের কোলনে গ্যাসটা আটকে যাওয়ার দরুন। এই উপসর্গটিকে বলা হয় হেপাটিক ফ্লেকসার সিনড্রোম। লিভার কিন্তু এতে কোনোভাবেই দায়ী নয়।
পঞ্চমত, ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের কারণেও পেট ব্যথা করে। ল্যাকটোজ এনজাইম না থাকার জন্য দুধ যথাযথভাবে পাচিত না হয়ে এই ব্যথা তৈরি করে। সেজন্য অনেকেরই সরাসরি দুধ তো দূরের কথা, চায়ের সামান্য দুধ থেকেও ব্যথা হয়। এই রোগীর দুধ বন্ধ করলেই উপকার পাবেন।
ষষ্ঠত, আগেই বলা হয়েছে ক্রনিক পেট ব্যথার অন্যতম কারণ হল কৃমি। আবার অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে কৃমির ওষুধ খেলে পাতলা পায়খানা হয়। এই ভুল ধারণার পরিবর্তন করতেই হবে।
সপ্তমত, অনেকেই মুড়ি-মুড়কির মতো মেট্রোজিম ট্যাবলেট খান। অথচ কোলোনোস্কোপি করার সময় আমরা ক্রনিক অ্যামিবায়োসিস প্রায় দেখিই না। আমাশা নয়, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের কারণেই পেট ব্যথা করে এবং পায়খানায় আম বা মিউকাস পড়ে। তাহলে প্রশ্ন এসে যায় মেট্রোজিল কাজ দেয় কেন? কারণটা আসলে মানসিক তৃপ্তি। রোগী মেট্রোজিল খেয়ে একটা মানসিক স্বস্তি বোধ করেন। আর সেজন্যই মনে করেন পেট ব্যথা কমে গেছে। কিন্তু সাবধানতার সুরে বলি যাদের ক্রনিক আমাশা আছে তারা ওষুধ খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।
অষ্টমত, না জেনেই ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের রোগীরা খাদ্যকালিকা থেকে অনেক খাবারই বাদ দিয়ে দেন। তার বদলে শুধু সেদ্ধ খাবার খান। এটা একটা ভুল ধারণা যে সেদ্ধ খেলেই পেট ব্যথা হবে না। বাড়িতে রান্না করা স্বাভাবিক তেল মশলাযুক্ত খাবার খেলে কোনো অসুবিধাই হবে না। এটাও মনে রাখা দরকার লিভারের রোগে বেশি ক্যালোরি প্রয়োজন। তাই না খেয়ে থাকলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। পেপটিক আলসারের রোগীরা অতিরিক্ত ফ্যাট, দুধ, শুকনো লষ্কা, কোল্ড ড্রিষ্কস ইত্যাদি ত্যাগ করলেই ভালো।
নবমত, অহেতুক ভয় না পেয়ে অ্যাবডোমিনাল পেনের সময় এন্ডোস্কোপি করিয়ে নেবেন। তবে অভিজ্ঞ ডাক্তারবাবুদের কাছে এন্ডোস্কোপি করতে সময় লাগে দেড় থেকে দু’মিনিট।
দশমত, পেটের সমস্যায় অনেকসময় বায়োপসি করতে হয়। বায়োপসি করা মানেই ক্যানসার হয়েছে—এমন ভাবনার কোনো কারণ নেই। আর বায়োপসির অর্থ হল কোনো টিস্যুকে মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে পর্যবেক্ষণ করা ও রোগটির সঠিক কারণ অনুসন্ধান করা। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্যানসার নয়।
একাদশতম, শীতকালীন শাকসবজি বা এমনি সময়ের শাকপাতা (ক্রসিফেরাস ভেজিটেবলস) খেলে পেট ব্যথা বেশি হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। যেটা মানতে হবে তা হল একদিনে সব ধরনের শাকসবজি না খেয়ে নিয়ম করে ঘুরিয়ে ফিরেয়ে খেলে কোনো সমস্যাই হবে না।
চিকিৎসা যখন বাড়িতে
এই ধরনের আলোচনায় এটা পরিষ্কার যে পেট ব্যথা নানা কারণে হচ্ছে যেমন ঠিক, তেমনি বাস্তবে মাথা ব্যথারও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই পেট ব্যথা। এই সংকটের মধ্যে রোগীর বাড়ির লোককে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কত তাড়াতাড়ি রোগীকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। পেটে ব্যথা যদি সামান্য হয় ও নিজে থেকেই সেরে যায় তাহলে সেরকম চিন্তা থাকে না। কিন্তু বিপরীত পরিস্থিতি দেখা দিলে অথাংৎ পেট ব্যথা যদি তীব্র থেকে তীব্রতর হয় তাহলে দেরী করা মানেই ঝুঁকি নেওয়া। রোগী যদি বমি করে, পায়খানার সঙ্গে যদি রক্ত আসে, পেট ভীষণ ফুলে যায়, হাত-পা যদি ক্রমশ ঠান্ডা হতে থাকে, পালস বিট যদি বেড়ে যায়, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাস্থকেন্দ্র নিয়ে যাওয়া উচিত।
দিনের বেলায় ব্যথা হলে দিনের সমস্যা দিনেই সেরে ফেলতে চেষ্ট করুন। কেন না রাতে সব পরিষেবা ঠিকমতো না পাওয়া যেতে পারে। সকালে কিছু পরীক্ষার পর যদি রোগী সুস্থ বোধ করেন তা হলেও সন্ধেবেলায় ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি। আমরা অনেক সময় কোনো পারগেটিভ ছাড়াই পেটের এক্স-রে করতে বলি। এরকমক্ষেত্রে মেডিকেল ডায়াগেনোস্টিক টিমের সদস্যদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। যারা ইতিমধ্যেই জানেন যে তাদের পেট ব্যথার কারণটি কী বিষয়ে, তাদের বলব আপনার যে ওষুধ খেয়ে ভালো ছিলেন সেটাই আবার শুরু করুন। যেমন কোনো একজন ব্যক্তি পেপটিক আলসারে ভুগছেন এবং তিনি সেই বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকলে তার উচিত সেই মহূর্তে দু’ একটি বাজারচলতি অ্যান্টাসিড খাওয়া। তাছাড়া মোচড় দিয়ে পেট ব্যথাতে অ্যান্টিস্প্যাজমোডিক (ড্রোটাভেরিন, ট্রামাডল, ডাইসাইক্লোমিন, হায়োসায়ামিন আছে) ওষুধ খেতে পারেন। ব্যথার তীব্রতা বেশি হলে পেন্টাজোসিন ইঞ্জেকশণ নিতে পারেন। আবার যাদের নন আলসার ডিসপেপসিয়া আছে তাদের পাকস্থলির মুভমেন্ট কম থাকে। এসব রোগী ডমপিরিডন জাতীয় ওষুধ খেলে ভালো থাকবেন। ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের রোগীদের জন্য সুখবর আছে। আজকাল এমন ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে যা খাদ্যনালীর স্পর্শকাতরতা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে। তবে আমাদের পরামর্শ হল, নিজে থেকে চিকিৎসা করার চেয়ে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই দ্রুত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হবে।
উপসংহার
বাঁচতে হলে খাবার চাই, এটা সত্য। এর থেকে বড় সত্য হল খাবার হজম করতে পেটের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর পেট যখন আছে পেট ব্যথাও থাকবে। আগের বলা কথা আবার বলি, পেট হল একটা ‘ম্যাজিক বক্স’। একজন ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিক যেমন অন্য ম্যাজিকের থেকে আলাদা, ঠিক তেমন পেট ব্যথার প্রতিটি কারণ ও চরিত্র আলাদা-আলাদা। রোগী, রোগীর আত্মীয়স্বজন ও ডাক্তারবাবুরাই পারেন এই ম্যাজিক বক্সের রহস্য ভেদ করতে। অর্থাৎ পেট ব্যথার প্রকৃত কারণটি খুঁজে বার করে তার সমাধান করতে। পেট ব্যথার চিকিৎসায় কোনো ফিজিশিয়ানের মতামতের সমান গুরুত্বর্পর্ণ হল একজন সার্জেনের মতামত। অ্যাপেন্ডিসাইটিস, গলব্লাডারে পেন, পেপটিক পারফোরেশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে একজন সার্জেনের সহায়তা ভীষণ দরকার হয়ে পড়ে। একজন ফিজিশিয়ান, একজন গ্যাসট্রোএন্টারোলজিস্ট যদি হাতে হাতে মিলিয়ে চিকিৎসাকার্য সম্পাদন করতে এগিয়ে আসেন তাহলে খুব তাড়াতাড়ি রোগ নিরাময় করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন